কলি যুগ

বৈদিক মতানুসারে বর্তমানে কলি যুগ চলছে। কলি যুগের আগে আরও তিনটি যুগ আমরা অতিক্রম করে এসেছি যথা সত্য যুগ যা স্বর্ণ যুগ নামে পরিচিত, তারপর ত্রেতা যুগ যা রৌপ যুগ নামে পরিচিত, তারপর দ্বাপর যুগ যা তাম্র যুগ নামে পরিচিত ও সব শেষে কলি যুগ যা লৌহ যুগ নামে পরিচিত। প্রতিটি যুগের কিছু সময়কাল আছে। এই নিয়ে নানান প্রাচীন গ্রন্থে নানান মত আছে। এই চারটি য্যগের যুগাবর্তকাল হল ১২০০০+১২০০০= ২৪০০০ বছর।

বিভিন্ন পূরাণ থেকে আমরা জানতে পারি প্রতিটি যুগ ১২০০ বছর করে কমে অর্থাৎ সত্য যুগ ৪৮০০ বছর সময় কাল ধরে, ত্রেতা যুগ ৩৬০০ বছর সময় কাল ধরে, দ্বাপর যুগ ২৪০০ বছর সময় কাল ধরে ও কলি যুগ ১২০০ বছর সময় কাল ধরে। আবার এও জানতে পারি প্রতিটি যুগ ৩০০০ বছর** করে। মোট ১২০০০ বছর সত্য যুগ থেকে কলি যুগ, আবার তা ১২০০০ বছর ঘুরে সত্য যুগে এসে শেষ হবে।

ইংরাজী ক্যালেন্ডার শুরু হয়েছে যিশুখ্রিষ্টর জন্ম থেকে। দ্বিতীয় মতানুসারে যুগের শুরু হয়েছে যিশুখ্রিষ্ট জন্মের ১২৬৭৬ বছর আগে। প্রতিটি যুগের ৩০০ বছর কাল সংক্রমণগত কাল আছে। কলি যুগের উধর্বগ কালে আমরা রয়েছি যা শেষ হওয়ার কথা ২৩২৫ সালে।

শেষ হওয়ার কথা মানে কি পৃথিবী কি ধংস হয়ে যাবে? না না পৃথিবী ধংস হবেনা। কলি যুগের নানান প্রভাব আমরা দেখতে পারছি, মানুষ ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করছে, সততার অভাব দেখা দিয়েছে, সহ্য ক্ষমতা কমছে, মানুষের ধৈর্য্য কমছে, আয়ু কমছে, শারীরিক ক্ষমতা কমছে, মানুষ কুঁড়ে  হচ্ছে, স্মৃতিশক্তি ধীরেধীরে কমছে, ন্যায় বিচার ধীরে ধীরে কোন একজনের ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে, অর্থ সম্পদ দিয়ে মানুষের মানদণ্ড স্থীর হচ্ছে, মানুষের ব্যবহার ক্রমশ রুঢ় হচ্ছে, বর্তমানে মহিলা পুরুষরা উপরিগত আকর্ষনের লোভে এক সাথে থাকা শুরু করেছে, জাতপাত নিয়ে চরম অশান্তি চলছে, যৌন ক্ষমতার নিরিখে একজন মহিলা বা পুরুষকে তার মহিলাত্ম বা পুরুষত্ব বিচার করা হচ্ছে, বাহ্যিক আকর্ষন বা লোক দেখানো ভাবের জন্য মানুষের মনে আধ্মাত্মীক চেতনার অভাব দেখা দিচ্ছে, এক ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্মের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে, যারা কথার খেলা (juggling) করতে পারে তারা শিক্ষিত বলে গণ্য হবে, দেখবেন যাদের ভালো রোজগার করেন না বা যারা অতি সাধারন জীবনধারণ করবে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে নানান প্রশ্ন বা চাপ থাকবে। পৃথিবীটা আস্তে আস্তে দুর্নীতিতে ভরে যাবে, দুর্নীতিগ্রস্থ লোকে ভরে যাবে, তারাই রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারি হবে। করের চাপ বাড়বে, দুর্ভিক্ষ হবে, ক্ষুদার জ্বালায় মানুষ মরবে, লোকক্ষয় হবে, ঝড়, বৃষ্টি, গরম, ঠাণ্ডায় মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠবে, ঝগড়াঝাটি, রোগভোগ, ক্ষুদামন্দা, আবেগ উৎকন্টাতে মানুষ পাগল হবে, মানুষ একে অপরকে ঘৃনা করবে, আরাদ্ধ দেবতাদের নিয়ে ছেলেখেলা হবে, তাঁকে ভাঙ্গিয়ে অর্থ, নাম, যশ, প্রতিপত্তি কামানোর চেষ্টা চলবে, দেবতার আরাধনার আড়ালে অপকর্ম চলবে, ধর্ম সম্বন্ধে যাদের কোন জ্ঞান নেই তারা কথার খেলায় ধর্মকে এমন ভাবে উপস্থাপনা করবে যাতে লোকে তাদেরকে উচ্চ স্থানে বসাবে। প্রকৃত ধার্মিক যারা বা যারা প্রকৃত ধর্ম প্রচারক বা প্রকৃত ধর্মগুরু যারা তাদের গুরুত্ব ভীষন রকম কমে যাবে।  শ্রীমদ্‌ ভগবৎ গীতা গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে কলি যুগের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

কলি যুগ শেষ হলে কলি যুগের সংক্রমণগত কাল ৩০০ বছর শুরু হবে, তার পর আবার দ্বাপর যুগের শুরু। কলি যুগের একদম শেষের দিকে ঈশ্বরের উপর যখন মানুষের ভরসা থাকবেনা, যারা সজ্জন ব্যক্তি বা তথাকথিত সাধক তাদেরও মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ত হ্রাস পাবে, সরকারের মাথায় নিম্নজাতের (নিম্ন রুচির) মন্ত্রী আমলারা বসবেন, সমস্ত মানুষের মধ্যে ত্যাগ মানসিকতাটা লোপ পাবে তখনই কলকি অবতারের জন্ম হবে কোন এক ব্রাহ্মণের ঘরে। তিনি একজন যদ্ধা হিসাবে জন্মাবেন, তাঁকে কল্পনা করা হয়েছে একটি সাদা ঘোড়ার ওপর কলকি দেবতা হাতে একটি অশি রনংদেহী মূর্তীতে।

আমাদের শাস্ত্রে নানান ধরনের পুরান আছে, তার মধ্যে লিঙ্গ পুরান, বায়ু পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ এই সকল পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি কলকি অবতার কলি যুগের শেষে তিনি জন্মগ্রহণ করার বত্রিশ বছর পর থেকে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবেন কুড়ি বছর ধরে, এই কুড়ি বছরে তিনি তাঁর সাথে এক বড় সৈন্য (পরিচ্ছন্ন আধ্যাত্মিক মানসিকতার ব্রাহ্মণ) বাহিনী নিয়ে (পুরাণে আছে যাতে অনেক ঘোরা, হাতি, রথ, সমরাস্ত্র যা মন্ত্র দ্বারা সক্রিয়, ব্রহ্মাস্ত্র থাকবে) সাথে নানান আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ করবেন পৃথিবীর অসচ্ছ লোকেদের সাথে এবং তাদের পরাজিত করবেন। কেউ তাঁকে থামাতে পারবেনা। পুরাণ থেকে জানা যায় যুদ্ধ শেষে কলকি অবতার গঙ্গা যমুনার মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় অবস্থান করে অল্প কিছু লোক (যে কয়জন পরিচ্ছন্ন আধ্যাত্মিক মানসিকতার ব্রাহ্মণ অবশিষ্ট থাকবে) নিয়ে (যাদেরকে তিনি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবেন) মন্ত্রীসভা গঠণ করে রাজত্ব করবেন ও পৃথিবীকে সত্য যুগে উন্নিত করবেন। সত্য যুগে পৃথিবীকে উন্নিত করার পর তিনি আবার অনন্তকালে গমন করবেন। সত্য যুগের সুচনা হবে। আবার আগের কথায় ফিরে আসি – পৃথিবী ধংস হবেনা, পৃথিবী থেকে আসদতা শেষ হয়ে সততা প্রতিষ্টা পাবে ও সত্য যুগের সুচনা হবে।

** আগে আলচনা করেছি যে বিভিন্ন পূরাণ থেকে আমরা জেনেছি যে এক যুগাবর্ত ১২০০০ বছর যার মধ্যে চারটি যুগ আছে-সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ। প্রতিটা যুগ ৩০০০ বছর করে। এটি আমরা সপ্তর্ষী (সপ্ত ঋষি)ক্যালেন্ডারে পাই যা ভারতের কয়েকটি জায়গায় এখনও ব্যবহার হয়।

সাতটি তারা দিয়ে সপ্তঋষি-উপরের ছবিটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি।ইংরাজীতে একে গ্রেট বিয়ার বলা হয়। আমরা জানি আমাদের ২৭টি নক্ষত্র আছে, এই সপ্তঋষি ২৭ টি নক্ষত্রের প্রতিটিতে ১০০ বছর করে থাকে, তাই ২৭x১০০= ২৭০০ বছর।প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে বাকি ৩০০ বছর কোথায় গেলো? ১৫০ বছর ১৫০ বছর করে ২৭০০ বছরের আগে ও পরে্ যোগ হয়ে ৩০০০ বছর হবে। প্রতিটি যুগের ক্ষেত্রে একই নিয়ম। দিনের শুরুতে যেমন ভোর  সন্ধ্যা হয় তেমনই এখানেও প্রতিটা যুগের শুরু ও শেষে ১৫০ বছর করে ভোর ও সন্ধ্যা থাকে, একে বলা হয় সংক্রমণ কাল। সংক্রমণ  কাল হল এক রীতি নীতি, স্থান, অবস্থা, বিষয় থেকে অন্য রীতি নীতি, স্থান, অবস্থা, বিষয়ে পরিবর্তন।

আমার ব্যক্তিগত ধারণা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগে আমাদের যে পঞ্চইন্দ্রিয় আছে, যা দিয়ে আমরা সব অনুভব করি বা বুঝি বা দেখি, এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের বিভিন্ন প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এই পঞ্চইন্দ্রিয়র দুই রকম ব্যবহার আছে, এক অন্তর ইন্দ্রিয় ও দুই বাহ্যিক ইন্দ্রিয়। এই চার যুগের প্রথম থেকে অন্তর ইন্দ্রিয়র ব্যবহার হতে হতে কলি যুগে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়র ব্যবহারে এসে পৌঁচেছি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে এক চরম অরাজগতা চলছএ। চতুর দিকে অশান্তি, অভাবনীয় নানান ঘটনা ঘতছে, যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরী হ্যেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো যুদ্ধ লেগেই র‍য়েছে, পরিবেশ দুষনের তয়াক্কা কেউ করছেনা, ঈশ্বরকে নিয়ে ছেলেখেলা শুরু হয়েছে, অরাজগতার চূড়ান্ত পর্যায় আমরা সকলে এসে পৌঁচেছি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ আগে হয়ে গেছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কড়া নাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্র্রখভাব ও পরোক্ষভাবে ২০ থেকে ২৫ দেশ জড়িয়ে প্রেছিল। আমার ধারণা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর বেশি দেশ জড়িয়ে পরবে।

সারা পৃথিবীতে যে অশান্তি চলছে তার মূল কারণ হল প্রচণ্ড ভাবে ব্যক্তিপূজা বেড়ে যাওয়ার জন্য মানুষ তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে, নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার, জড়বাদের উপর মানুষের অত্যধিক নির্ভরশীলতা, আদ্ধাত্মিকতা থেকে মানুষের সরে যাওয়া, ধর্মকে বিক্রিত করে তাকে নিয়ে খেলা করা, তথাকথিত ধর্মগুরু যারা ধর্মকে বিক্রিত করে নিজেদের স্বার্থে মানুষকে প্রলভিত করছে, তাদের ইচ্ছা মতন ধর্মকে চালনা করতে চাইছে, এই সবই পৃথিবীর রজ ও তম গুণের প্রকপে ঘটছে।

একটু যদি খেয়াল করে দেখেন দেখবেন ১৯৭০-৭২ সাল থেকে ১৯৯০-৯২ সাল পর্যন্ত নানান ঘড়েল বিবাদ চলেছে, তার পর থেকে প্রায় ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়, মোটামুটি ভাবে ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দিরে দেবদেবী নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়, সমাজে রজ ও তম গুনের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সত্যগুণ থেকে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি সরে যেতে থাকে। মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা তাড়াতাড়ি লোপ পেতে থাকে, বর্তমানে লোক দেখানো আধ্যাত্মিকতা প্রবল ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মন্দির মস্‌জিদ পুরাতত্ত্ব স্মৃতি সৌধ ধংসে মানুষ মেতেছে। এই জিনিষটা উত্তরোত্তর আরও বাড়বে/বেড়েছে, ২০১০ সালের পর থেকে উগ্রপন্থিদের দৌরাত্ম অনেক অনেক বেড়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রবল ভাবে বাড়বে, দেশের মধ্যেও নানান  কারনে উত্তেজনা বাড়বে, রাষত্রকে টুকরো টুকরো করার অপচেষ্টা চলবে ও তা বাড়বে, মানুষের মধ্যে অধৈর্য্য ভাব উত্তরোত্তর বাড়বে, বিভিন্ন দেশ তার সৈন্য ক্ষমতা দেখাতে শুরু করবে, ছোটোখাটো যুদ্ধ হতে পারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে বই কমবেনা। ২০১৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশ তাদের মানসিক চাপ ধরে না রাখতে পারার জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিতি পাবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পরবে। বহু লোকক্ষয় হবে, অসৎ লকের সংখ্যা কমবে, আধ্যাত্মিকতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে। অসৎ কাজ থেকে ধীরে ধীরে মানুষ সরে আসতে শুরু করবে।  সারা পৃথিবীতে সনাতন ধর্মের প্রচার শুরু হবে। এই সনাতন ধর্মের পথ পথপ্রর্দশক হবে ভারত।

২০২৫ সালের পর থেকে আমরা ধীরে ধীরে যুগ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাব, কিন্তু পৃথিবী ধংস হবেনা, হবে যেটা তা হল নানান কারণে বহু লোকক্ষয় (অসৎ লোক) হয়ে সত্যের পথে এগিয়ে যাবে।

 

ডঃ শ্রীমতি রমা সান্যাল

Leave a Reply